আশুরা কী?
“আশুরা” শব্দটি আরবি ‘আশারা’ (عشرة) থেকে এসেছে, যার অর্থ দশ। হিজরি বছরের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখকে বলা হয় আশুরা। এই দিনটি ইসলামী ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও হৃদয়বিদারক। এই দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে, বিশেষত কারবালার মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি মুসলমানদের হৃদয়ে গভীরভাবে দাগ কেটে আছে।
পবিত্র আশুরার ইতিহাস
পূর্বের নবীদের ঘটনা
আশুরার দিন বহু নবী ও তাঁদের জাতির জন্য ছিল পরিত্রাণ ও বিজয়ের দিন। বিভিন্ন হাদিস থেকে জানা যায়:
এই দিনেই হজরত নূহ (আ.)-এর নৌকা জুদি পাহাড়ে অবতরণ করে।
হজরত মূসা (আ.) এই দিন ফেরাউনকে পরাজিত করেন এবং বনি ইসরাইল মুক্তি লাভ করে।
হজরত আদম (আ.)-এর তাওবা কবুল হয় এই দিনেই।
হজরত ইউসুফ (আ.) কারাগার থেকে মুক্ত হন এই আশুরার দিন।
কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা
৬১ হিজরির ১০ মহররম ইরাকের কারবালা প্রান্তরে ঘটে যায় ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবারকে ইয়াজিদের সেনারা নির্মমভাবে শহীদ করে। এই ট্র্যাজেডি মুসলিম উম্মাহকে ন্যায়, সত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের শিক্ষা দেয়।
আশুরার ফজিলত ও আমল
হাদিসের আলোকে আশুরার মর্যাদা
রাসূল (সা.) বলেছেন:
“আমি আশাকরি আল্লাহ আশুরার রোজার মাধ্যমে গত বছরের গুনাহসমূহ মাফ করে দিবেন।”
(সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১১৬২)
আশুরার রোজা
আশুরার দিন রোজা রাখা সুন্নাত। তবে ১০ মহররমের সাথে ৯ অথবা ১১ মহররম মিলিয়ে দু’দিন রোজা রাখা উত্তম।
“তোমরা আশুরার দিন রোজা রাখো এবং ইহুদীদের বিরোধিতা করো। এক দিন আগে অথবা পরে রোজা রাখো।”
(মুসনাদ আহমাদ)
দোয়া ও ইবাদত
আশুরার দিন বেশি বেশি দোয়া, কুরআন তিলাওয়াত, ইস্তিগফার ও দান-সদকা করা উত্তম। হাদিসে আছে, আশুরার দিনে পরিবারের সদস্যদের জন্য খরচ বাড়ালে সারা বছর রিজিকের প্রশস্ততা হয়।
আশুরার শিক্ষা ও বার্তা
১. অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো
ইমাম হোসাইন (রা.)-এর আত্মত্যাগ আমাদের শেখায়, অন্যায়ের কাছে মাথা নত নয়; বরং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোই মুসলমানের কর্তব্য।
২. ধৈর্য ও ত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত
কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.) ধৈর্য, সাহস, ও ত্যাগের এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, যা কেয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
৩. আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা
নূহ (আ.) থেকে শুরু করে মূসা (আ.) ও ইমাম হোসাইন (রা.)-এর জীবন থেকে আমরা শিখি – বিপদ, কষ্ট, বা অন্যায় যত বড়ই হোক, আল্লাহর উপর আস্থা ও তাওয়াক্কুলই একমাত্র ভরসা।
আশুরা কবে ২০২৫
ইসলামিক বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ২০২৫ সালে ১০ মহররম (আশুরা) পড়বে ৫ বা ৬ জুলাইয়ের মধ্যে (চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল)। মুসলমানদের উচিৎ এদিন আগেভাগেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা—
১০ মহররম একটি পবিত্র ও ফজিলতপূর্ণ দিন। বহু সহিহ হাদিসে এই দিনের গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে।
রাসূল (সা.) বলেন:
❝আশাকরি, আশুরার দিনের রোজা বিগত এক বছরের গুনাহ মোচন করে দেয়।❞
(সহীহ মুসলিম, হাদিস: ১১৬২)
মহররম মাস কেন পালন করা হয়?
মহররম হলো হিজরি সনের প্রথম মাস এবং ইসলামি বর্ষপঞ্জির চারটি পবিত্র মাসের একটি। এই মাসকে আল্লাহর মাস (شهر الله المحرم) বলা হয়। মুসলমানরা এই মাস পালন করে ইসলামের ইতিহাস, রুহানি শিক্ষা এবং ত্যাগের স্মৃতি স্মরণ করে।
📌 পবিত্র আশুরা কি?
পবিত্র আশুরা হল ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম-এর ১০ তারিখ। এটি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় ঘটনা।
“আশুরা” শব্দটি এসেছে আরবি “আশারা” (عَشَرَة) থেকে, যার অর্থ দশ — অর্থাৎ মহররম মাসের দশম দিন।
মহররম কী?
মহররম হলো ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং এটি চারটি পবিত্র মাসের (আশহুরুল হুরুম) অন্যতম। ‘মহররম’ শব্দটি এসেছে আরবি "হারাম" থেকে, যার অর্থ নিষিদ্ধ বা সম্মানিত। এটি এমন একটি মাস যার মর্যাদা আল্লাহর কাছে অত্যন্ত উচ্চ।
আশুরার ফজিলত
আশুরা অর্থাৎ মহররম মাসের ১০ তারিখ, ইসলাম ধর্মে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ও তাৎপর্যবাহী একটি দিন। এটি এমন একটি দিন, যাকে রাসূল (সা.) নিজে রোজা রাখতেন, সাহাবীদের রোজা রাখতে উৎসাহ দিতেন, এবং একে অতীব সম্মানিত দিন হিসেবে ঘোষণা করতেন।
আশুরা সম্পর্কে হাদিস
রাসূল (সা.) বলেছেন:
❝আমি আল্লাহর কাছে আশা করি, আশুরার দিনের রোজা বিগত এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবে।❞
(সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১১৬২)
🔹 এটা আল্লাহর একটি বিশেষ করুণা, যে একটি দিনের রোজা রাখার মাধ্যমে একটি পুরো বছরের ছোটখাটো গুনাহ ক্ষমা হয়ে যায়।
নবী মূসা (আ.)-এর বিজয় দিবস
এই দিনই ছিল হজরত মূসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের ফেরাউন ও তার সৈন্যদের বিরুদ্ধে বিজয়ের দিন।
রাসূল (সা.) বলেন:
❝এই দিনটি সেই দিন, যেদিন আল্লাহ তায়ালা মূসা (আ.) ও তাঁর কওমকে উদ্ধার করেছিলেন এবং ফেরাউনকে ধ্বংস করেছিলেন। তাই আমি এই দিন রোজা রাখি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ।❞
(সহীহ বুখারী, হাদীস: ২০০৪)
রাসূল (সা.) নিজে রোজা রাখতেন
রাসূলুল্লাহ (সা.) আশুরার দিন রোজা পালন করতেন এবং সাহাবীদেরও উৎসাহ দিতেন।
❝তোমরা আশুরার রোজা রাখো এবং ইহুদীদের বিরোধিতা করে এক দিন আগে বা পরে মিলিয়ে রোজা রাখো।❞
(মুসনাদ আহমাদ)
✅ তাই সুন্নাত হলো:
৯ ও ১০ মহররম অথবা ১০ ও ১১ মহররম একসঙ্গে রোজা রাখা।
দান-সদকার ফজিলত
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
❝যে ব্যক্তি আশুরার দিন তার পরিবার-পরিজনের খরচ বাড়াবে, আল্লাহ তায়ালা তার রিজিক বাড়িয়ে দেবেন সারা বছরের জন্য।❞
(আত-তাবরানী ও বাইহাকী)
🔹 এই দিন দান-সদকা, আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া, এবং গরীবদের সাহায্য করলে আল্লাহ তা’আলা অশেষ বরকত দান করেন।
এই দিনে বহু নবীর তাওবা কবুল হয়েছে
হাদিস থেকে জানা যায়, এই আশুরার দিন:
হজরত আদম (আ.)-এর তাওবা কবুল হয়।
হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান।
হজরত ইব্রাহিম (আ.) আগুন থেকে নিরাপদে বের হন।
🔹 এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত, মাফ ও পরিত্রাণের দিন।
কারবালার আত্মত্যাগের স্মৃতি
১০ মহররমেই ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর পরিবার ইসলামের সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে শহীদ হন। এ ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয়:
অন্যায়ের কাছে মাথা নত নয়
সত্যের জন্য ত্যাগ স্বীকার শ্রেষ্ঠ কাজ
ধৈর্য, সাহস ও আখিরাতমুখী জীবনযাপন
আশুরা নিয়ে ভুল ধারণা
অনেক জায়গায় আশুরার দিনকে কেবলমাত্র শোক পালন বা মাতম করার দিন মনে করা হয়। তবে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সঠিক নয়। আশুরার মূল শিক্ষা হলো:
সত্য প্রতিষ্ঠা করা
অন্যায়ের প্রতিবাদ
ধৈর্যধারণ করা
ত্যাগ স্বীকার করা
আশুরার রোজা কয়টি
রাসূলুল্লাহ ﷺ আশুরার দিন (১০ মহররম) রোজা রাখতেন এবং ইহুদিদের সঙ্গে সাদৃশ্য না রেখে এক দিন বাড়িয়ে বা কমিয়ে দুই দিন রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন:
“যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) আশুরার রোজা রাখলেন এবং মুসলমানদেরও তা রাখতে আদেশ করলেন, তখন সাহাবারা বলল:
‘হে আল্লাহর রাসূল! এটি তো এমন দিন, যাকে ইহুদিরাও সম্মান করে।’
তখন তিনি বললেন:
❝পরবর্তী বছর ইনশাআল্লাহ আমরা ৯ তারিখও রোজা রাখব।❞”
(সহীহ মুসলিম, হাদিস: ১১৩৪)
উপসংহার
আশুরা মুসলমানদের জন্য কেবল শোক নয়, বরং এটি এক অনন্য আত্মত্যাগ ও সত্যের বিজয়ের স্মারক। কারবালার ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চাই সাহস, ত্যাগ ও আল্লাহর উপর ভরসা। আশুরার ফজিলত ও শিক্ষা যথাযথভাবে গ্রহণ করলে আমাদের জীবন আলোকিত হবে এবং সমাজে শান্তি ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।